Wednesday, 25 April 2012

হে মোর দুর্ভাগা দেশ... | আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর






দু’জন মহিয়সী নারী আমাদের দেশ ও জাতির নেতৃত্ব দিচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। তাঁরা আন্দোলন করেছেন। কষ্ট সয়েছেন। একাধিক বার রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছেন। তাঁদের কথায় লক্ষকোটি মানুষ ওঠে বসে। প্রয়োজনে জান দিতে ও দ্বিধা করে না। যাঁদের প্রতি মানুষের এত আস্থা, এত আনুগত্য, এত ভালোবাসা, এত শ্রদ্ধা, তাঁরাই যখন জাতির কোন সংকটময় মুহূর্তে অসংলগ্ন উক্তি কিংবা যুক্তিহীন বেফাঁস মন-ব্য করেন, তখন সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গাটা প্রবলভাবে নড়ে ওঠে। বল-ভরসা বলে কোন অবলম্বন আর বাকি থাকে না।




‘চ্যাং উজায়, ব্যাঙ উজায়, পুঁটি কয় মুঁইও উজাম’-এই লোক প্রবচনটি এতদঞ্চলের মানুষের কম বেশি সকলেরই জানা। তাই এর সরলার্থের প্রয়োজন হয় না। তবে এখানে এটি উল্লেখ করার শানে নজুল হিসেবে একটুখানি ব্যাখ্যার প্রয়োজন। দেশের বর্তমান পরিবেশ-পরিসি'তি খুবই নাজুক। শুধু নাজুক বললে সঠিক বলা হয় না। বলা যায় উদ্বেগজনক। এমনিতে টানা কয় দিনের হরতালে দেশবাসী বিপর্যস্ত। তার উপর বেঘোরে পড়ে যারা জানমাল হারাচ্ছে তাদের কথা, তাদের পরিজনের কথা চিন-া করলে তো পেটের ভাত আর হজম হয় না।
বিএনপি নেতা ইলিয়াছ আলীর নিখোঁজ হওয়া, সাবেক রেল মন্ত্রীর এপিএস-এর অর্থ কেলেঙ্কারি, তার ড্রাইভার আলী আজমের নিরুদ্দেশ হওয়া, পিকেটারদের আগুন লাগানো বাসে ঘুমন্ত অবস্থায় ড্রাইভার হায়দার আলীর পুড়ে মরা, হরতাল সমর্থকদের তাড়া খেয়ে মাইক্রোবাস নিয়ে পালানোর পথে দুর্ঘটনায় তরুণ ড্রাইভারের মর্মান্তিক মৃত্যু, সাংবাদিক দম্পতি সাগর রুনী আর সৌদি কূটনীতিকের হত্যাকাণ্ড নিয়ে কূল কিনারা করতে না পারা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে দেশের বড় বড় লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী এন্তার লিখছেন। কেউ কেউ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের টকশোতে সাহসী বক্তব্য রাখছেন। সেখানে আমর মত একজন অতি ক্ষুদ্র মানুষের এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে যাওয়া ‘আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর’ বৈকি।

এবার আসল কথায় আসি। বেশ ক’দিন থেকে এসব বিষয়ের কোন কোনটি মাথায় ঢুকে এমন যন্ত্রণা দিচ্ছে সেগুলো মাথা থেকে না নামিয়ে কিছুতেই স্বসি- পাচ্ছি না। আর এ জন্যই অধমের এই অক্ষম প্রয়াস।

দু’জন মহিয়সী নারী আমাদের দেশ ও জাতির নেতৃত্ব দিচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। তাঁরা আন্দোলন করেছেন। কষ্ট সয়েছেন। একাধিক বার রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছেন। তাঁদের কথায় লক্ষকোটি মানুষ ওঠে বসে। প্রয়োজনে জান দিতে ও দ্বিধা করে না। যাঁদের প্রতি মানুষের এত আস'া, এত আনুগত্য, এত ভালোবাসা, এত শ্রদ্ধা, তাঁরাই যখন জাতির কোন সংকটময় মুহূর্তে অসংলগ্ন উক্তি কিংবা যুক্তিহীন বেফাঁস মন-ব্য করেন, তখন সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গাটা প্রবলভাবে নড়ে ওঠে। বল-ভরসা বলে কোন অবলম্বন আর বাকি থাকে না।

বিএনপি’র একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা সিলেটের ইলিয়াছ আলী। নানা কারণে তিনি শুধু বিএনপি’র কাছেই নন, গোটা দেশবাসীর কাছেই বেশ পরিচিত। সহসা তিনি তার ড্রাইভারসহ নিখোঁজ হয়েছেন। লোকটা আর আদৌ তার স্নেহের সন্তানদের কাছে, প্রিয়তমা পত্নীর কাছে জীবিত অবস্থায় ফিরে আসতে পারবেন কিনা তাই নিয়ে চরম দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগ নিয়ে কাল কাটাচ্ছেন তার স্বজনরা। অথচ স্পর্শকাতর এই বিষয়টি নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং মাননীয় বিরোধী দলীয় নেতা অবিবেচনা প্রসূত যেসব উক্তি প্রত্যুক্তি করছেন তা দেশবাসীকে দারুণভাবে হতাশ করছে।
প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ইলিয়াছ আলী তার নেত্রীর নির্দেশে লুকিয়ে থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা ইস্যু সৃষ্টির পায়তারা করছেন। কিছুদিন আগে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মন-ব্য করতে গিয়েও তিনি বলেছিলেন, কারো বেডরুম পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের নয়। এসব কথা কি তিনি জেনে বুঝে বলেন, নাকি শুধু প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার লক্ষ্যে উচ্চারণ করেন? দলের একজন সাধারণ নেতাকর্মী এ ধরনের দায়হীন উক্তি করলে হয়তো কারো কিছু বলার থাকেতো না। কিন্তু তিনি তো প্রধানমন্ত্রী। দেশের সকল মানুষের অভিভাবক। সকলের ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব তাঁর। তিনি কীভাবে এ ধরনের মন-ব্য করেন?
অপর পক্ষে ইলিয়াছ আলীর নিখোঁজ হওয়ার পরপরই বিরোধী দলীয় নেতা বললেন, ইলিয়াছ আলীকে সরকারের নির্দেশে র‌্যাব গুম করেছে। এ ধরনের ঘটনা যে ঘটছে না তা হলফ করে বলা যাবে না। কিন' তার মত দায়িত্বশীল একজন মানুষ বিনা প্রমাণে এ ধরনের ঢালাও মন-ব্য করেন কীভাবে? তিনি কিংবা তাঁর লোকজন বিষয়টা সম্পর্কে কি নিশ্চিত হয়েছেন? আর হলে তো ঘটনাটা এতদূর গড়ানোর কথা নয়। আর একটা বিষয় তাঁর সচেতনভাবেই ভাবা উচিৎ। তাঁর একটা উক্তি কিংবা নির্দেশ দেশে তোলপাড় কাণ্ড ঘটিয়ে দিতে পারে। তার পরিণতি হতে পারে মারাত্মক। তেমন আলামতও তো দেখা যাচ্ছে।
দুর্ভাগ্য এ জাতির, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরে এমন একজন হৃদয়বান, প্রজ্ঞাবান নেতা আর পাওয়া গেল না যিনি অন-ত কোন একটা সময়কালের জন্য হলেও গোটাজাতিকে আপন পরিবার মনে করে তার কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন, কথা বলেছেন।

দুই একদিন আগের একটি দৈনিকে দেখলাম দেশের কোন একটি থানায় বিরোধী দলের দু’জন কর্মীকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। এদের একজনকে ছাদে ঝুলিয়ে পেটানো হচ্ছে, আর একজনকে নির্যাতন করা হচ্ছে হাত-পা বেঁধে মেঝেতে ফেলে। কাগজটিতে শুধু প্রতিবেদন নয়, প্রমাণ হিসেবে ছবি ও ছাপা হয়েছে।
এই সংবাদ অথবা ছবি দেশবাসীর অন-রে কতটা আঘাত করতে পেরেছে জানি না। কিন্তু এই দু’টি ছেলের পরিবারের লোকজন যে কি অসহায়ভাবে আহাজারি করছে তা আমি বেশ অনুমান করতে পারছি। রক্ষকই যখন ভক্ষক তখন কার কাছে যাবে এরা নালিশ জানাতে। কে-ই বা করবে প্রতিকার। কি নিদারুণ অসহায়ত্ব!

১৯৭৫ সালের গোড়ার দিকের কথা। তখন আমি প্রত্যক্ষ রাজনীতির সাথে জড়িত। বিশেষ ক্ষমতা আইনের ভয়ে, নিরাপত্তা বাহিনীর তাড়া খেয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। তখনও ঠিক আজকের মতই সবকিছুতেই শুধু ভয় আর ভয়। কখন খুন হব, কখন গুম হব, কখন গ্রেফতার হব, গ্রেফতার হলে কি ধরনের নির্যাতনের শিকার হব, জীবিত আর ফিরতে পারবো কিনা, এইসব ভয়।
এর মধ্যেই একদিন রক্ষীবাহিনীর হাতে আটকা পড়লাম। বর্তমান জেলা পরিষদের ডাকবাংলোয় তখন রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্প। আমি দেখলাম সামনের মাঠে ঘাসের উপর খালি গায়ে পড়ে আছে একজন মানুষ। শিয়রে নতুন একটা গামছায় একখণ্ড পাউরুটি। মাছি ভনভন করছে। বিস্ময় আর আতঙ্কের সাথে লক্ষ করলাম লোকটা মৃত। তার সারা শরীরে নির্মম নির্যাতনের চিহ্ন। সেন্ট্রির কাছেই শুনলাম মনোহরপুর ইউনিয়নের একটা মার্ডার কেসের সন্দেহভাজন আসামী হিসেবে তাকে ধরে আনা হয়েছিল।
সন্ধ্যায় রক্ষীবাহিনীর লিডারের মুখোমুখি হলাম। তখনও বারান্দার সামনে লাশটা পড়ে আছে। সম্ভবত তখন পর্যন- তার পরিবার এই ভয়ঙ্কর খবরটা জানেই না। আমি কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে লিডারকে জিজ্ঞেস করলাম, এই লোকটা মার্ডারের সাথে জড়িত কিনা তা প্রমাণের আগেই যে ওকে মেরে ফেললেন, কাজটা কি ঠিক হলো?
লিডার ভয় ধরানো দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য ভরে বললো, ভালো কাজ করতে গেলে অমন দু’একটা দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে।
ইচ্ছা থাকলেও আমি আর তার ‘ভালোকাজ’ নিয়ে বেশি উচ্চবাচ্য করলাম না। তারপর আমার ভগ্যে কি ঘটেছে সে কথা আজ আর এখানে বলতে চাই না।
এখানে শুধু একটা ঘটনার উল্লেখ করলাম মাত্র। সেই সময় থেকে পরপর দুই দুইটি সরকার তাদের নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে প্রতিবাদী রাজনৈতিক কর্মীদের উপর যে নির্মম নির্যাতন চালিয়েছিল সে কথা মনে পড়লে আজও গা শিউরে ওঠে। তাদের অনেকে এখনও জীবিত আছেন কালের সাক্ষী হয়ে। লক্ষনীয় বিষয়, তাদের বেশির ভাগই ছিলেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন-ান, বীর মুক্তিযোদ্ধা।
সেই থেকে প্রায় ৪০ বছর দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে আবার যখন দেখি, সেই একই রকম নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে, গুম, খুন, সেই একই স্টাইলে  রাজনৈতিক কর্মীদের উপর নির্মম নির্যাতন, আবারও যখন দেখি মিটিং মিছিলে যেতে হয় প্রাণ হাতে করে, হরতালের দিন বাইরে বেরোতে হয় স্বজনদের কাছে বিদায় নিয়ে, শয়ন ঘরে থেকেও যখন খুনীর হাত এড়ানো যায় না, তখন এই জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা করার আর কিছু বাকি থাকে না।
আক্ষেপে বিক্ষেপে শুধু রবীন্দ্র নাথকেই উদ্বৃত করতে হয়: হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান/ অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান / মানুষের অধিকারে  বঞ্চিত করেছ যারে / সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান/ অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান॥


অধ্যাপক মাজহারউল মান্নান
শিক্ষক ও লেখক
ইমেইলঃ mazharmannan@gmail.com
সেলঃ ০১৭১৫২০৫৬৭৮

No comments:

Post a Comment